
বাংলাদেশের ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থায় আসছে ঐতিহাসিক পরিবর্তন। এতদিন পর্যন্ত সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডে ভুল বা ত্রুটি দেখা দিলে দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করে তা সংশোধনের সুযোগ ছিল। কিন্তু এবার সরকার সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে রেকর্ড সংক্রান্ত কোনো ভুলের সংশোধনের জন্য আর আদালতে মামলা করা যাবে না।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুরনো এনালগ পদ্ধতির রেকর্ড ব্যবস্থা এখন থেকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তার পরিবর্তে চালু হচ্ছে বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে (বিডিএস) রেকর্ড, যা হবে শতভাগ নির্ভুল এবং ত্রুটিমুক্ত। এই ডিজিটাল রেকর্ড বাস্তবায়নের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ও ভূমি সচিব এএসএম সালে আহমেদ।
বিডিএস রেকর্ড প্রকল্প অনুযায়ী, নতুন এই ডিজিটাল রেকর্ডে ভুলের হার থাকবে শূন্য শতাংশ। রেকর্ডে কোনো ভুল হয়েছে বলে দাবি করে ভবিষ্যতে কেউ মামলা দায়ের করতে পারবে না। আদালতও এমন মামলা গ্রহণ করবে না। সরকারের ভাষায়, রেকর্ড সংক্রান্ত মামলাকে এবার বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই ‘চিরতরে বিদায়’ জানানো হচ্ছে।
২০২৬ সালের শুরু থেকেই দেশের সব জেলায় একযোগে এই বিডিএস রেকর্ড কার্যক্রম শুরু হবে। ভূমি মালিকদের এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে যারা ইতোমধ্যে রেকর্ড সংক্রান্ত মামলায় রয়েছেন বা পুরনো রেকর্ডে বড় ধরনের ভুল রয়েছে, তাদের জন্য এখনো সুযোগ আছে। সরকার জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। এজন্য দেওয়ানী কার্যবিধি আইনে তিনটি বড় সংশোধন আনা হয়েছে—
সময়সীমা সীমিত: এখন থেকে বাদী বা বিবাদী সর্বোচ্চ দুইবার সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারবে। বারবার সময় চাওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। এতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
ডিজিটাল সাক্ষ্যগ্রহণ: সাক্ষীরা এখন থেকে সরাসরি আদালতে হাজির না হয়েও ভিডিও কল, ইমেইল, মেসেঞ্জার, ইমু বা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে পারবেন। এতে দীর্ঘসূত্রিতা কমবে।
হয়রানিমূলক মামলায় শাস্তি: কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা হয়রানির জন্য মামলা দায়ের করে, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানা ও কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
পূর্বে এই জরিমানার পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টাকা, তবে এখন তা ৫০০ টাকায় নামানো হয়েছে এবং সঙ্গে জেলও যুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২০ লাখেরও বেশি দেওয়ানী মামলা চলমান, যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই রেকর্ড সংক্রান্ত। এই মামলাগুলোর কারণে ভূমি মালিকরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি বছর পর বছর আদালতের দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে।
সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে রেকর্ড সংশোধনের মামলা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলে এই দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তির অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন যারা পুরনো ভুল সংশোধন করতে চান, তারা দ্রুত দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করে বিডিএস রেকর্ড শুরু হওয়ার আগেই নিষ্পত্তি করে নিতে পারবেন। ২০২৬ সাল থেকে নতুন ডিজিটাল রেকর্ডের আওতায় এলে আর কোনো মামলা করার সুযোগ থাকবে না।
এর ফলে ভূমি মালিকরা সঠিক মালিকানা নিজের নামে নিবন্ধন করতে পারবেন এবং ভবিষ্যতে ভুল রেকর্ড, জালিয়াতি বা ভূমি বিরোধের ভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারবেন।